তেঁতুলিয়ায় মূর্তিমান আতঙ্কের নাম লালু
 
                                                                                                একসময় করতেন গরুর দালালি। পরে শুরু করেন গরু-ছাগল চুরি। ছাগল চুরির অপরাধে প্রকাশ্য সালিসে তাঁর শাস্তিও হয়েছিল। সেই তিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। জমি দখলবাজ হিসেবেও রয়েছে তাঁর পরিচিতি। সরকারি জমি দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছেন গুদাম। নদী দখল করে ড্রেজার মেশিন দিয়ে রাতের অন্ধকারে অবৈধ পাথর উত্তোলনের অন্যতম হোতা তিনি। খুনের একাধিক মামলার এই আসামির ভাইদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষুদ্র চা চাষিরা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না চা-পাতা। কথায় কথায় এলাকার নিরীহ মানুষের ওপর চলে নির্যাতন। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি আর মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকার মানুষকে হয়রানি করা তাঁর নেশা। করোনার এই দুর্যোগের সময় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে তাঁকে অতিথি না করায় সেখানেও দিয়েছেন বাধা। বহু অপকর্মের হোতা মূর্তিমান এই আতঙ্কের নাম নুরুল ইসলাম লালু। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান ইউনিয়নের পত্নীপাড়া এলাকায় তাঁর বাড়ি। ওই এলাকার সোহরাব আলীর ছেলে লালু।
সরেজমিন অনুসন্ধানে শালবাহান ইউনিয়নের শিক্ষক, শ্রমিক, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ এলাকার ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা লালু ও তাঁর ভাইদের নানা অপকর্ম ও নির্যাতনের কথা। 
চিহ্নিত দখলবাজ নুরুল ইসলাম লালু একজন চিহ্নিত দখলবাজ। শালবাহান ইউনিয়নের অন্তত ১৫ জন নিরীহ মানুষের কয়েক একর পৈতৃক জমি দখল করেছেন লালু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরের দিন কালান্দিগছ বাজারে বেশ কিছু দোকানপাট লুটপাট ও দখল করে শুরু হয় তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন। কালান্দিগছ হাটে ২০ শতক সরকারি জমি দখল করে সেখানে নির্মাণ করেছেন গুদাম। দখল পাকাপোক্ত করতে সেখানে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানিয়ে বানিয়ে ফেলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস। সরকার থেকে কালান্দিগছ হাট ইজারা নিয়েছেন হায়দার আলী নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু সেটি লালুর অবৈধ দখলে। তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের বিড়ালিতে অন্যের জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন চা-বাগান। 
ওই এলাকার জাহিরুল ইসলামের ছেলে নাজমুল ইসলাম লিখিতভাবে জানান, তাঁর ৭৫ শতক পৈতৃক জমি ২০০৯ সাল থেকে গায়ের জোরে দখল করেছেন এই লালু। গত ২৩ মার্চ সেটলমেন্ট অফিসার জমির তদন্তে এলে তাঁর সামনেই লালু, লালুর ছেলে সবুজ, ভাই তারা মিয়া ও বাবুল আকতার, ভাতিজা সাকিব মিলে নাজমুলকে মারধর করেন। নাজমুলের বৃদ্ধা মা বাধা দিতে গেলে তাঁকেও পেটানো হয়। এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কয়েক দিন পর এ নিয়ে মামলা দিতে গেলে ‘জখম নেই’Ñএই অজুহাতে থানা মামলা নেয়নি। 
ছোট দলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘কালান্দিগছ বাজারে আমার জমি দখল করার পাঁয়তারা করছে লালু। আমার পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে হুমকি।’ কয়েক দিন আগে কালান্দিগছ বাজারে সাত্তার মাস্টারের জমি দখল করেছে লালু গং। সাত্তার মাস্টার উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ইয়াছিন মণ্ডলের শ্যালক।
চাঁদাবাজি এলাকায় চাঁদাবাজ হিসেবেও পরিচিত লালু। এলাকায় থাকতে কিংবা ব্যবসা করতে হলে লালুকে চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই। একাধিক ভুক্তভোগী জানান, শালবাহান পশুর হাট থেকে লালু নিয়মিত চাঁদা তোলেন। 
কালান্দিগছ এলাকার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘লালু আমার বাবার কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে। লালুর আতঙ্কে এলাকার শতাধিক পরিবার রাতে ঘুমোতে পারে না।’
চুরির অভিযোগ এক দশক আগে লালু গরু বেচাকেনার দালালি করতেন। সীমান্তে গরু চোরাকারবারিতেও জড়িত ছিলেন তিনি এবং তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য। সীমান্তে গরু পাচারের সময় বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান লালুর ভাগিনা আবু হানিফ খাজা। শালবাহান ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানের আমলে ছাগল চুরির অপরাধে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের উপস্থিতিতে লালুকে শাস্তি দেওয়া হয়। ওই সালিসে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সীমান্তে চোরাকারবারি হিসেবে লালুর নাম থানাসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় আছে। 
কোটি কোটি টাকার মালিক নুরুল ইসলাম লালু ও তাঁর তিন ভাই তারা মিয়া, বাবুল আক্তার, মনিরুজ্জামান ফনি বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক। স্থানীয় লোকজন জানায়, ২০০৮ সালের আগেও আর্থিক কষ্টে ছিলেন লালু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম ব্যবহার করে ডাহুক নদী দখল করে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন শুরু করেন লালু। সেই থেকেই রাতারাতি কোটিপতি হতে শুরু করেন লালু। টাকার গরমে এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর শুরু হয় লালু ও তাঁর ভাইদের নির্যাতন। 
একাধিক খুনের আসামি লালুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। বেশ কয়েকটি খুনের মামলা রয়েছে লালু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। 
শালবাহান রোডের ইউনুছ আলী বলেন, লালু ও তাঁর ভাইয়েরা এমন দুর্ধর্ষ যে কারো সঙ্গে সামান্য ঝগড়া হলেই তাঁরা দা-কুড়াল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। তেঁতুলিয়ার বোয়ালমারী এলাকার একাব্বর আলী হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি লালু। কয়েক বছর আগে লালুর ভাই ফনির ছেলে সাইফুল, মোল্লার ছেলে শাকিব মিলে প্রাণজোত এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলীর স্কুল পড়ুয়া  ভাতিজিকে ধর্ষণ করেন। 
অবৈধ বোমা মেশিন বন্ধে শ্রমিক নিহতের ঘটনা মামলার আসামিও এই লালু।
তেঁতুলিয়া মডেল থানায় লালুর বিরুদ্ধে করা খুনের মামলাগুলো হলো : মামলা নম্বর ২, তারিখ ২-৯-২০০৯, ধারা ১৪৩/৩২৩/ ৩২৫/৩২৬/ ৩০৭/৩০২/ ৩৫ জিআর ৮৩/২০০৯ এবং মামলা নম্বর ৪, তারিখ ১১-৭-২০০৭, ধারা ১৪৩/৪৪৭/ ৩২৩/৩২৪/ ৩২৫/৩০৭/ ৩০২/৩৪, জিআর ৪৬/৭। 
চা-পাতা কালোবাজারি  আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার পরিচয় ব্যবহার করে লালুর ভাই বাবুল স্থানীয় ফাবিহা টি ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেন। বর্তমানে ওই কম্পানিতে ব্যাপক চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন লালু। প্রতি কেজি চা-পাতায় ৫০ পয়সা কমিশন নেন লালু। কৃষকের কাছ থেকে পাতা কিনলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নেন। একইভাবে রাতের অন্ধকারে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে টন টন চা-পাতা খোলা বাজারে বিক্রি করেন লালু। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচারও করা হয়। 
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নুরুল ইসলাম লালু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার সব মিথ্যা। আমি নির্বাচন করি, তাই একটা পক্ষ আমার পেছনে লেগেছে। আমার বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা ছিল, তা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আমার ও আমার পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ 
লালুর ভাই বাবুল আক্তার বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। অভিযোগগুলো কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। 
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘সরকারি জমি দখলের বিষয়টি আমরা খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’  
পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, ‘কথিত লালু আওয়ামী লীগের কেউ নয়। কিছু নেতার নাম ভাঙিয়ে সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আমাদের কাছে লালুর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে। করোনাকালে গরিব মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কাজেও সে বাধা দিয়েছে। সাংগঠনিকভাবে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 
পঞ্চগড় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ‘যেকোনো পরিচয়ই থাকুক না কেন, অপরাধী আমাদের কাছে অপরাধীই। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ছাড়া যারা ভুক্তভোগী, তাদের অনুরোধ করব থানায় অভিযোগ করতে। অভিযোগের সত্যতা পেলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
                                
 
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                    
                   
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                             
                                                            